5G বা ৫ম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক নিয়ে যত কথা
কয়েক বছর আগে টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে অ্যাডভারটাইজমেন্ট গুলোতে দেখা গেল থ্রিজি নিয়ে মোবাইল অপারেটরদের মাঝে তুমুল মাতামাতি। এর আগে আমরা যে মোবাইল নেটওয়ার্ক গুলো ব্যবহার করতাম সেগুলো ছিল টুজি কানেকশান। থ্রিজিতে পদার্পণ করার পর আমরা দেখতে পেলাম ইন্টারনেটের গতি বেড়ে গেলো বহুগুণ। সাথে চলে এলো আনুষঙ্গিক আরো নতুন অনেক সেবা। থ্রিজি আসার পর বহুদিন পার হয়ে গেল। এরপর একদিন শুরু হলো ফোরজি নিয়ে একি রকম মাতামাতি। একে একে সকল মোবাইল অপারেটরই ধাবিত হল ফোরজির দিকে। ইন্টারনেটের গতি এবং অপারেটরদের সার্ভিসে আবারো দেখা গেল আমূল পরিবর্তন।
ফোরজির যুগে পা রাখার কিছুদিন পরেই ঘোষণা করা হলো ফাইভ জির। এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা আরো বহুগুণে বেড়ে গেল মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস বা এম ডাব্লিউ সিতে ফাইভ জি সাপোর্টেড কিছু মোবাইল ফোনের প্রদর্শনের মাধ্যমে। যদিও ওয়ারলেস সিস্টেমের এই পঞ্চম প্রজন্মের সাথে আমরা খুব একটি পরিচিত নই, তবুও এটি আমরা সবাই জানি যে প্রতিটি প্রজন্মের সাথে সাথে আরো নতুন এবং উন্নততর ফিচার নিয়ে আসে এই ওয়ারলেস সিস্টেম। তাহলে ফাইভ জি কি, কি কি নতুন সংযোজন হচ্ছে ফাইভ জি মোবাইল নেটওয়ার্কে, কবে নাগাদ পেতে পারি ফাইভ জি সেবা গুলো, পূর্ববর্তী প্রজন্মের সাথে মূল পার্থক্য গুলো কি এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে 5G তা জানতে চলুন পড়ে নিই আজকের ব্লগটি।
ফাইভ জি কি?
ফাইভ জি হচ্ছে পঞ্চম প্রজন্মের ওয়ারলেস সিস্টেমের সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি একটি উন্নত প্রযুক্তির ওয়ারলেস নেটওয়ার্ক যা ২০১৮ এবং তার পরবর্তী সময়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। ফাইভ জিতে প্রাথমিকভাবে যেই প্রযুক্তি গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে মিলিমিটার তরঙ্গ ব্যান্ডের প্রণয়ন যা ২৪, ২৬, ৩৮ এবং ৬০ গিগাহার্টজের এবং এর গতি প্রতি সেকেন্ডে ২০ গিগাবাইট। মাল্টিপল ইনপুট মাল্টিপল আউটপুট -৬৪-২৫৬ অর্থাৎ সংক্ষেপে এম আই এম ও এর বৃহৎ পরিসরে প্রয়োগ। এটি ফোরজি থেকে ন্যূনতম ১০ গুণ বেশি কর্ম ক্ষমতা সম্পন্ন বলে ধারণা করা হয়। ফাইভ জি নিশ্চিত করতে পারবে ফোরজি থেকে দ্রুততর এবং নির্ভরযোগ্য সেবা।
কিভাবে কাজ করে ফাইভ জি?
ফাইভ জি নেটওয়ার্ক হচ্ছে ডিজিটাল সেলুলার নেটওয়ার্ক। এতে সার্ভিস প্রোভাইডার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ কৃত সার্ভিস এরিয়া গুলো ছোট ছোট জিওগ্রাফিক্যাল এরিয়াতে মোজাইকের মত ভাগ হয়ে যায়। এই ছোট ছোট ভাগ গুলোকে বলা হয় সেল। এনালগ সিগনাল গুলো এনালগ টু ডিজিটাল কনভার্টার ব্যবহার করে বিটস স্ট্রিমের পরিবর্তিত করে ফোনগুলোতে ট্রান্সমিট করা হয় এবং ফোনে সেই সিগনাল গুলো সাউন্ড এবং ইমেজ আকারে ডিজিটালাইজড হয়। প্রতিটি সেলের 5G ওয়ারলেস ডিভাইস গুলো রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে লোকাল এন্টেনা অ্যারে এবং নিম্ন ক্ষমতা সম্পন্ন অটোমেটিক ট্রান্সসিভার বা ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে। লোকাল এন্টেনা গুলো হাই ব্যান্ডউইথ অপটিকাল ফাইবার অথবা ওয়ারলেস ব্যকোহল কানেকশনের মাধ্যমে টেলিফোন নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকে।
মিলিমিটার ওয়েভের রেঞ্জ মাইক্রোওয়েভ থেকে ক্ষুদ্র। এ কারণেই সেলগুলো তুলনামূলক ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে থাকে। ভবনের দেয়ালে অতিক্রম করতে ও এই ওয়েভ গুলোর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
পারফরম্যান্স
ফাইভ জি টেকনোলোজি মূলত সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তার পারফরমেন্সের জন্য। 5G টেকনোলজির সাথে পারফরম্যান্সে যে মূল পরিবর্তনগুলো আসছে চলুন সেগুলো জেনে নেই।
স্পিড
ফাইভ জি নিউ রেডিও কানেকশন গুলোর স্পিড ৬ গিগাহার্জ ব্যান্ডের নিচের এবং একই পরিমাণ স্পেকট্রাম এবং অ্যান্টেনা সম্বলিত ফোরজি নেটওয়ার্ক হতে দ্রুততর। তবে কিছু থ্রী জি পি পি জি নেটওয়ার্ক অ্যাডভান্সড ফোরজি নেটওয়ার্ক থেকে ধীর গতির। ফাইভ-জি স্পেসিফিকেশনে রয়েছে লাইসেন্স অ্যাসিস্ট্যাড অ্যাকসেস অর্থাৎ LAA, যদিও ফাইভ-জিতে এখন পর্যন্ত LAA প্রদর্শন করা হয়নি। কিছু ব্যতিক্রম মিলিমিটার ওয়েভ স্পেকট্রামে স্পিড অনেক গুণে বেশি হয়ে থাকে।
ল্যাটেন্সি
ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের এয়ার ল্যাটেন্সি টার্গেট হচ্ছে ১ থেকে ৪ মিলিসেকেন্ড। যদিও ২০১৩ সালে ইকুইপমেন্ট শিপিং এ পরীক্ষা করে ৮ থেকে ১২ মিলি সেকেন্ডের ল্যাটেন্সি পাওয়া যায়। সার্ভার গুলো ল্যাটেন্সি এয়ার ল্যাটেন্সিতে সংযুক্ত করা আবশ্যক। ভেরাইজনের পূর্ব নিযুক্ত 5Gতে ৩০ মিলি সেকেন্ডের ল্যাটেন্সি রিপোর্ট করা হয়েছে।
ফাইভ-জি সাপোর্টেড ডিভাইস গুলো
২০১৯ এর মার্চ মাসে গ্লোবাল সাপ্লাইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন পুরো বিশ্বব্যাপী ফাইভ জি সাপোর্টেড ডিভাইসের প্রথম একটি ডাটাবেজ প্রকাশ করে। গ্লোবাল সাপ্লাইয়ার্স এসোসিয়েশন এরেই ডাটাবেজে ২৩ টি কোম্পানি তাদের ৩৩ টি পৃথক ডিভাইসে 5G এর সাপোর্ট নিশ্চিত করে। এই ডিভাইসগুলো সাতটি ফর্ম ফ্যাক্টরে ঘোষণা করা হয়। ফর্ম ফ্যাক্টর গুলো হল মোবাইল ফোন, হটস্পট, ইনডোর এবং আউটডোর কাস্টমার প্রেমিসেস ইকুইপমেন্ট, মডিউলস, স্ন্যাপ অন ডঙ্গল এবং এডাপ্টার এবং ইউএসবি টার্মিনাল।
5G এর খারাপ দিক
সকল যুগান্তকারী উদ্ভাবনেরই ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও থাকে কিছু খারাপ দিক। ফাইভ জি ও তার ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যে এর কিছু ত্রুটি আমাদের কাছে ধরা পড়েছে এবং এর থেকে কিছু সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা বেড়েই চলেছে জনসাধারণের মাঝে। চলুন দেখে নেই কী সেগুলো।
ইন্টারফেসে সমস্যা
ফাইভ জিতে ব্যবহার করা স্পেকট্রাম গুলো আবহাওয়া কিংবা অবজারভেশন স্যাটেলাইটের মত রিমোট সেন্সিং টেকনোলোজি গুলোর খুব কাছাকাছি। বিশেষ করে জলীয় বাষ্প মনিটর করার টেকনোলজির স্পেকট্রাম 5G এর সাথে প্রায় মিলে যায়। তাই ইফেক্টিভ কন্ট্রোল ছড়া ইন্টারফেস গুলোকে ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ইউনাইটেড স্টেটস এর সেক্রেটারি অফ কমার্স উইলবার রস এবং নাসা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জিম বার্ডেনস্টাইন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এফ সি সিকে কিছু স্পেকট্রাম অকশন প্রপোজাল তুলে নেয়ার আহ্বান জানান। যদিও প্রপোজালটি ফিরিয়ে দেয়া হয়।
রেডিয়েশন নিয়ে আতঙ্ক
২০১৮ সাল থেকে কিছু গ্রুপ তৈরি হয়েছে যারা ফাইভ জি ডিপ্লয়মেন্টের বিরোধিতা করে আসছে। যদিও প্রশাসনের অধিকাংশই বিশ্বাস করে না যে 5G এর জনসাধারণের স্বাস্থ্যের ওপর কোনো প্রভাব রয়েছে। বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে রেডিয়েশনের আতঙ্কে একটি 5G ট্রায়াল বন্ধ করা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা তেও কোন এক অজানা কারণে 5G এর একটি পরিকল্পিত আপগ্রেড বন্ধ করা হয়। গণমাধ্যমে এ নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কিছু কিছু গণমাধ্যমে 5G কে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু গণমাধ্যমে এই ধরনের দাবি গুলোর পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির অভাব রয়েছে বলে দাবি করা হয়। সর্বোপরি জনসাধারণের মাঝে ব্যাপার গুলো একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
গুপ্তচর বৃত্তির আতঙ্ক
অনেকেই মনে করেন চাইনিজ ইকুইপমেন্ট ভেন্ডর থেকে আমদানিকৃত ফাইভ জি টেকনোলজি গুলো গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ব্যবহার করা হতে পারে। এ কারণে একাধিক দেশে ফাইভ জি নেটওয়ার্কের জন্য চাইনিজ ইকুইপমেন্টের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চিনা ভেন্ডর এবং সরকার এই দাবি গুলোকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
প্রথম 5G সাপোর্টেড ফোন
ফাইভ জি সাপোর্টেড প্রথম ফোনটি হল লেনোভর মোটো সাব ব্র্যান্ডের মোটো জি থ্রী স্মার্টফোনটি। একটি মোটো মড এর মাধ্যমে ফোন ফাইভ জি আপগ্রেডেবল। মটোরোলা ভেরাইজজের সাথে পার্টনারশিপে যায় এই ফোনটি লঞ্চ করার জন্য। এরপর ধীরে ধীরে স্যামসাং এবং হুয়াওয়ের মত বড় বড় ব্র্যান্ড গুলো তাদের 5G সাপোর্টেড ফোন গুলো অ্যানাউন্স করতে থাকে। স্যামসাংয়ের 5G সাপোর্টেড প্রথম ফোনটি হলো গ্যালাক্সি এস টেন 5G। হুয়াওয়ে স্মার্টফোনটি হলো মেইট এক্স।
5G এবং বাংলাদেশ
বাংলাদেশ 5G এর প্রবেশ ঘটবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব মোস্তফা জব্বার এটি নিশ্চিত করেন। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে পুরো দেশে 5G সেবা প্রদান করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য বড় বড় মোবাইল অপারেটর গুলোও 5G প্রযুক্তি প্রয়োগে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার পুরো বিশ্বকে আমাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। সেই আবিষ্কার গুলোকে সহজে ব্যবহার করার জন্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট আবশ্যক একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে থ্রিজি আসার আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে কানেক্টেড মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক কম। কিন্তু থ্রিজির সাথে সাথে দ্রুতগতির ইন্টারনেট মানুষের হাতের মুঠোয় এসে পড়ায় সোশ্যাল মিডিয়া গুলোতে এবং অন্যান্য ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস গুলোর সাথে মানুষ হয়ে উঠেছে সুপরিচিত। ফলে সহজ হয়ে উঠেছে গ্লোবালাইজেশনের প্রক্রিয়াটি। এই দ্রুতগতির ইন্টারনেট এবং গ্লোবালাইজেশনের ফলে দেশের স্টার্টআপ গুলোতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি সুন্দর কিছু পরিবর্তন।
অনলাইনে খাবার অর্ডারের জন্য এসে পড়েছে ফুডপাণ্ডার মত অ্যাপ্লিকেশন। ট্রান্সপোর্টেশনে সুবিধার জন্য এসে পড়েছে আমাদের নিজেদের দেশীয় পাঠাও অ্যাপ্লিকেশন। উবারের মত বিদেশি সেবাগুলো দেশে এসে পড়েছে। এর সব কিছুই সম্ভব হয়েছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট মানুষের হাতে থাকায়। ইন্টারনেট সার্ভিস যত ভালো হবে, তার সাথে সম্পর্কিত এসব সেবাগুলো হবে আরো উন্নততর। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সাথে ইন্টারনেট টেকনোলজি গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আশা করা যায় ফাইভ-জি টেকনোলজির সাথে দেশের জন্য বই আসবে এমনই চমৎকার আমূল পরিবর্তন। তরুণরা এই পরিবর্তন নিয়ে আসবে এই টেকনোলজির ব্যবহার করে নিজেদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে।
কেমন লাগলো আমাদের আজকের লেখাটি? কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। নতুন কোন কিছু নিয়ে জানতে চাইলে আমাদের জানাতে পারেন। প্রযুক্তি নিয়ে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে আমাদের সাথে থাকুন। চোখ রাখুন আমাদের ফেইসবুক পেইজে এবং প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য যোগ দিন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপে।
জ্ঞান চর্চা চলুক অবিরাম, প্রতিদিন
Reference: Wiki, What is 5G, global-database-of-commercial-5G-device
5g-plans-over-radiation-rules, 5G mobile technology factsImage Credit: 9to5mac